“প্ল্যানচেটে সুব্রত মুখার্জী"
(বিদেহী কাহিনী কবিতা)
ডঃ অরুণ চক্রবর্তী
কালী পূজোর অমাবস্যার রাত, খবর এলো রাত সাড়ে আটটায়! পরলোক গমন করেছেন সুব্রত মুখার্জী!
অকস্মাৎ বাকরুদ্ধ হয়েছিলাম!
দুদিন পরে অভিজ্ঞ মিডিয়াম, তিনি দর্শনের অধ্যাপক, মধ্য বয়সী, মালয়ালী, শিবরাম কুট্টি!
অনুরোধ করলাম, স্যার, শুনেছি, আপনি, প্রেত ডাকতে পারেন ও কথাও বলাতে পারেন! সিয়ানস বসান, আমরা সুব্রত মুখারজী কে ডাকতে চাই। উনি রাজী হচ্ছিলেন না, বললেন, উপস্থিত প্রত্যেকেই কি তোমরা ভদ্রলোক কে চেনো?
আমরা তিনজন বললাম, হ্যাঁ, স্যার।
স্পষ্ট জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের সকলের ইসিজি রিপোর্ট নিয়ে কালকে সন্ধ্যায় এসে দেখা করো! যদি,তাঁর ছবি থাকে তাও নিয়ে এসো। আমরা পরের দিন ইসিজি, রিপোর্ট নিয়ে পৌঁছলাম, সঙ্গে সুব্রত মুখার্জীর পরিণত বয়সের ছবি।
আমাদের বাইরের ঘরে বসিয়ে, ছবিটা নিয়ে ভেতরে গেলেন, মিনিট পনেরো বাদে, ফিরে এসে বললেন, আগামী তিনদিন বাদ দিয়ে, তোমরা চতুর্থ
দিন এসে সন্ধ্যে বেলা দেখা করো।
ইসিজি রিপোর্ট গুলো জমা রাখলেন!
উত্তরে বললেন, এগুলো আমরা রেখে দেব, প্রয়োজনে লাগতে পারে।
আমরা উঠলাম, চতুর্থ দিন সন্ধ্যে বেলা আমরা হাজির হলাম, প্রফেসর কুট্টির বাড়ী, পুরনো দোতলায় কাঠের সিঁড়ির সঙ্গে কাঠের লম্বা সরু দালান।
আমাদের নিচেই জুতো, মোজা ছেড়ে আসতে হয়েছিলো। উনি বলে উঠলেন, মেঝেতে মোটা গদীর দিকে তাকিয়ে, তোমরা এখানে সবাই বসো,
একটা সাদা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললেন, সবাই যে যার নাম, গোত্র, লিখে দাও, তান্ত্রিক রক্ষা কবচ তৈরী হবে। এক ঘন্টা লাগবে। ততক্ষণ, তোমরা ওনার স্মৃতি কথা চিন্তা করো।
কুট্টি স্যার, নিচের দিকে গেলেন।
আমরা সুব্রত দার কথা চিন্তা করতে লাগলাম, ওনার চলা ফেরা, ওনার হাসি, ওনার কন্ঠস্বর, ইত্যাদি। কুট্টি স্যার, কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এলেন, একটি মালা, ধূপ, ধুনো, হাতে! আমাদের মাঝখানে একটি বেদী, সাদা কাপড়ে ঢাকা, আমাদের সবার সামনে ছোট ছোট রাইটিং টেবল। ছোট রাইটিং প্যাড আর পেন্সিল। মাঝখানে, সুব্রত দার ছবি। মালা পরিয়ে দেওয়া হলো, ধূপ জ্বলছে, সারা ঘরে ঘুরে ঘুরে, উনি বিড়বিড় করে কিছু মন্ত্র আওড়াচ্ছেন, আর ধূনোর ঘন ধোঁয়ায় দু হাত দূরের লোক কে দেখা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে, আরেকজন ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেছে, নাম শ্রীধরন আইয়ার, তামিল ব্রাহ্মণ! পূজোপাঠ নিয়েই, থাকেন! উনিই আজকে মিডিয়াম, অর্থাৎ সুব্রত দা ওনার ভেতরেই আবির্ভূত হবেন। ধীরে, ধীরে, দরজা, জানালা বন্ধ করা হলে। যেন কেটে দেওয়া হলো, বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সব সংযোগ! মিডিয়াম বসলেন মাঝখানে! আমরা দু ফিট দূরে দূরে ঘিরে বসলাম ওনাকে।
কুট্টি স্যার কোন শব্দ পর্যন্ত করতে নিষেধ করলেন, শুধু নিবিড় ভাবে সুব্রত দা কে স্মরণ করতে বললেন। মিনিট কুড়ি চোখ বুঁজে বসে আছি, কিচ্ছু টের পাচ্ছি না আমরা কেউ! সহসা ঘরের ছাদের দিক থেকে, একটা গোঙানীর শব্দ যেন ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামতে লাগলো। আমরা তিনজনে তিনজনের হাত চেপে রইলাম, বুঝতে পারলাম, কিছু একটা হতে যাচ্ছে। ঐ গোঙানীর শব্দ বেড়ে গেলো! প্রফেসার কুট্টি প্রথম প্রশ্ন করলেন, কে আপনি? ভর হওয়া মিডিয়াম বলতে লাগলো, আমি সুব্রত মুখার্জী, কুট্টি সাহেব প্রশ্ন করেন, আপনি গোঙাচ্ছেন কেন? উত্তর আসে, “বুঝতে পারছিস্ না, আমি কষ্ট পেয়ে মরেছি, বুঝতে পারছিস না, আমার কষ্ট হচ্ছে! আমাকে কেন এনেছো এখানে?" এবার আমি না থাকতে পেরে জিজ্ঞেস করি, দাদা আপনার কন্ঠস্বর তো এতো ভারি নয়! আমরা যাঁকে ডাকছি তিনি তো ধরা গলায় কথা বলেন, সামান্য ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলা! অপর দিক থেকে প্রশ্ন আসে, তুই কে? আমি নাম বলি, আবার কিছুক্ষণ সব চুপচাপ! ভয়ংকর নিস্তব্ধতা! গলা ভেসে এলো, আমি তোকে চিনি না! আমি আবার প্রশ্ন করি, হেমু দাকে চিনতেন? সুশোভন দা? বাবলু দা? আবার সব চুপচাপ! আমি নিশ্চিত হলাম, ইনি সুব্রত দা নন। এবার শেষ প্রশ্ন করি, আচ্ছা দাদা আপনাকে কোথায় চিকিৎসা করা হয়েছিলো, একটু বলতে পারেন… চুপচাপ… উত্তর এলো গম্ভীর গলায়, কলকাতায়।
হাল ছাড়লাম না, ফের প্রশ্ন করলাম, দাদা কোন হসপিটাল? আর উত্তর এলো না, কুট্টি স্যার শুনছেন, স্যার হাল্কা স্বরে বলেন, বলো, আমি বললাম, ওঁকে চলে যেতে বলুন, ইনি সুব্রত দা নন। কুট্টি বলে ওঠেন, আই ওয়ান্ট ইউ টু লিভ মাই মিডিয়াম এন্ড দিস রুম, ইমিডিয়েটলি।
স্বর ভেসে আসে, আমার ক্ষিধে পেয়েছে, আমাকে খেতে দাও। কুট্টি বলেন, এখানে খাওয়ানো হয় না, আপনি যান! স্বর ভেসে আসে, আমাকে খেতে দাও, তবে যাবো। কি আশ্চর্য্য বললাম না, এখানে কুশল বিনিময় করা হয়, খাওয়ানো হয় না! আপনি এখন যান, চুপচাপ, হঠাৎ অন্ধকার ঘরে দমকা বাতাস ঢুকলো, এবার মনে হলো আমাদের ইপ্সিত মানুষটি এলেন। একরাশ রজনীগন্ধার গন্ধ! হাল্কা ফ্যাঁসফেঁসে গলায় প্রশ্ন এলো! কৈ রে? আমাকে ডেকেছিস কেন? রসগোল্লা এনেছিস্? জানিস না, আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছিলাম! আমরা হাত জোড় করলাম, দাদা, অপরাধ, নেবেন না, রাগ করবেন না, দাদা, আপনি কোথায়? কিছুক্ষণ পরেই ঐ ধরা গলায় উত্তর এলো, আমি বায়বীয় শরীরে আকাশ পারে আছি! বন্ধু দের পেয়েছি। এখানে অনুভূতিতে কথা হয়; শব্দ করা যায় না, ইঙ্গিতে পূর্ণ এ জগত। আমার আগামী জন্ম আমাকে দেওয়া হবে একটু পরেই, এখুনি ডাক পড়বে, না পেলে ওরা পিছিয়ে দেবে! কারা ওরা দাদা? একটু বলবেন, ঐ তো ওরা আলোর শরীর, ওনারা সব কিছু চালনা করেন এখানে! আমাকে যেতে দে, যেতে দে। দাদা…..এই পৃথিবীতে কত মন খারাপ আপনাকে নিয়ে, কতো লোকে কাঁদছে, এসব শুনতে পারছেন! না, না, সব ভুল, সব সম্বন্ধ কিছুদিনের, শুধু ভুল, ভেসে বেড়াচ্ছি, ইউরোপের ইটালিতে জন্মাব আমি। সে খবর দেওয়া হয়ছে… বিরক্ত করিস না। যেতে দে, আমাকে যেতে হবে। কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা দাদা, আপনার ভালো হোক।
একটা শব্দ করে উল্টে পড়লেন মিডিয়াম, সশব্দে প্রায়ান্ধকার ঘরের জানালার কপাট খুললো আর বন্ধ হলো। রজনীগন্ধার সুবাস মিলিয়ে গেলো।
সদ্য প্রয়াত সুব্রত মুখার্জী এইবার অনন্ত কালের জন্য হারিয়ে গেলেন!
হারিযে গেলেন, কিন্তু, রেখে গেলেন অনেক প্রহেলিকাময় প্রশ্ন! যেমন “শুধু ভুল”, “সম্বন্ধ কিছুদিন”, “ভেসে বেড়াচ্ছি”, কে ওনাকে খবর দিয়েছে! “ইটালি তে জন্ম নেওয়ার” ব্যাপার! তবে কি আমরা যখন বিদেহী হই, তখন কোন এক্সট্রা ডাইমেনশনাল স্পেস এ সবাই থাকি! এক অনুভূতির কম্পাংকে, এক মনজগতে; বিচরণ করি, যেখানে এই পৃথিবীর; মুহূর্ত, মানে, অনুপল, পল, ঘন্টা, দিন, মাস, বছর, সবই অকিঞ্চিতকর!
স্পেস টাইম অনেক, অনেক ধীরে চলে, পৃথিবীর দ্রুত গতির সময় ঘূর্ণন নয়! আমি হায়ার ফিজিক্স নিয়ে চর্চা করি, তাই আমার মনে হিজিবিজির গণিত ঘুরপাক্ খেতে লাগলো! কোয়ান্টাম থিয়োরী ও জেনারেল রিলেটিভিটির দিকেই আমাকে সুব্রত দা, ঠেলে দিয়ে গেলেন, যা কিনা অনন্তর এক রূপের ঝলক! যা বস্তুবাদ কে ভেঙে ফেলে সামগ্রিক অস্বস্তি কর এক অধ্যাত্ম বাদের দিকে মননশীল মন ও হৃদয় কে ধাবিত করে!
আমরা “মৃত্যু” কে, টার্মিনাল বা “জন্ম”কেও টার্মিনাল বলতে পারছি না, ফোকাস; এক অন্য উচ্চতায় শিফট্ হচ্ছে। বস্তুবাদ, এক জায়গায়, অবস্তুবাদ কে লিংক করলে অসীম শক্তির ঠিকানা পাওয়া যায়! আর মনোজগৎ ও মৃত্যুকে লিংক করলে শূন্যতায় যাওয়া যায় যা আমাদের, এম্পটিনেস্ থেকে নাথিংনেস্ এ বিদেহী মনকে টেনে নিয়ে যায়; আর দেখায় এক অপূর্ব চেতনার জগত! যেখানে বিদেহী; নিজেই নিজের অস্তিত্বের ব্যাপারে; বুঝতে পারে, সে ঐ আশ্বস্থ অবচেতনে, অনেক সংস্কারিক সিদ্ধান্ত নেয়, সে তখন স্বাধীন ইচ্ছের অধিকারী হয়, সে চাইলে এই মরজগতে ফিরতে পারে পুনরায়; বা থেকে যায় ঐ মূল অবস্থায়! যাকে আমরা নির্বিকল্প সমাধির এক অংশ বলে জানি। সেখানে ভৌতিক ক্রিয়াদি থাকে না। ভালোমন্দ থাকে না, ক্ষিদে, তৃষ্ণা থাকে না! আলো ছায়া থাকে না! দিনরাত থাকে না! থাকে না ভৌত মহাজগতের কিছুই, তবু ভৌত জগৎ ও মনোজগৎ এক এনার্জি ট্রান্সফারে বাঁধা আছে, সংস্কার ও পুনঃ পুনঃ কর্মফল, খুব খুব গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের প্রতিটি জীবের ক্ষেত্রে, যা কিনা, আমাদের নতুন জন্মের বিল্ডিং ব্লক!
এইসব স্তর লাভ করতে হয় একের পর এক রূপান্তরের ভেতর দিয়ে। আরো জটিল মনোবৈজ্ঞানিক ও অতি উচ্চ ইগেন স্পেস পর্যালোচনা করলে, যা কিছুদূরে গিয়ে কোয়ান্টাম ইউনিভারস্ কে ছুঁয়ে ফেলছে ও ঈশ্বরীয় ভাববাদের উন্মেষ ঘটাচ্ছে! সর্ব ইচ্ছে, ভোগবাদ নিঃসীম শূন্যতায় অন্তর্হিত হয়!
ঈশ্বর, জ্ঞানী, মননশীল মস্তিষ্ক কে অনেক প্রজ্ঞার পরিক্ষায় অবতীর্ণ করে তবে মুক্তি পথে নিয়ে যান, কারণ পন্ডিতের কার্য্য কারণ শেষ হতে বিলম্ব হয়, আর অল্প জ্ঞানী যাওয়ার আর আসার পথ নিয়ে চিন্তিত থাকে না, যেমন বিষয়ভোগী, চার্বাক প্রকৃতি ও বধ্যপ্রাণীরই, এই নিয়মে মরজগতে বার বার আবির্ভূত হতে থাকে, আর পরম মুক্তি থেকে ভৌতিক ভোগের চোরাবালীতে আবার ডুবতে থাকে। আর শিশুর মতো পবিত্র এবং ঈশ্বর নির্ভরতা একমাত্র স্বল্প মুক্তির পথ। এদের পরীক্ষা হয় না!
যাইহোক, আরো বলতে গেলে এই কাহিনী কবিতা তার শিরোনামকেই বদলে দেবে! তাই, থামতে হলো আমাকে!
(REGISTERED UNDER COPYRIGHT ACT)
Tags:
Kobita/কবিতা