এই মন তোমাকে চাই
অনাদি মুখার্জি
ডিভোর্সের নোটিশ টা পেয়ে চমকে উঠেছিল মালা ! কেন চায় তার বর অ লোক ডিভোর্স ! কি তার অপরাধ ? মালা ডিভোর্সের নোটিশ পেয়ে তৎক্ষণাৎ অলোকের মোবাইলে ফোন করতে লাগলো ,কিন্তু তার মোবাইল বেজে যাচ্ছে ধরছে না অলোক ! এইসব দেখে মালার দুই চোখ দিয়ে জল নেমে আসে ! সেই মন থেকে মেনে নিতে পারছেনা কিছুতেই অলোকের এইরকম ডিসিশন ! এইটা কি অলোক চাই ? মালার মাথার মধ্যেই একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচছে ! তাদের সংসার তো খুব সুখের চলছিল ,শুধু দুটো বছর অলোক নিজেকে তার কাছ থেকে গুটিয়ে নিয়েছিল তা বলেই কি ডিভোর্স দিতে হবে ! মালার সাথে অলোকের বিবাহিত জীবন পনেরো বছর হতে চললো ,তাদের এক সন্তান ও আছে এই বয়সে ডিভোর্স নিয়ে কি হবে বলে মালা অলোকের দেওয়া ডিভোর্স নোটিশ টা রেখে দিল আলমারিতে !
একদিন কলেজের যাওয়া পথে ,কে যেন বলে উঠলো এই যে শুনছেন আপনাকে বলছি ! আপনি জানেন না আজ কলেছ ছুটি ! সাথে সাথে মালা তার চুল ঠিক করে মাথা ঘুরিয়ে দেখে তার সামনে এক হ্যান্ডসাম যুবক তাকে এই কথা বলছে ! মালা চিনতে পেরেছে তাদের কলেজের নতুন প্রফেস্যার অলোক কুমার মুখার্জি ! দেখা মাত্রই মালা বলে উঠলো আপনি নতুন এই কলেজের এসেছেন তাই না ,খুব ভালো লাগলো আপনার সাথে দেখা হয়ে ! প্রফেস্যার তখন সামান্য হেসে বললো তোমার নাম আমি শুনেছি তবে আজ দেখলাম তুমি অসধারণ সুন্দরী ,তাই নিজের থেকে একটু পরিচয় করতে এলাম ! মালা খানিকটা লজ্জাবোধ করলো ভাবতে পারছেনা এই নতুন প্রফেস্যার তাকে সুন্দরী বলবে ! তখন মালা তার ভ্রু নাচিয়ে বললো আচছা ,আপনি ও তো দারুণ হিরো ,কি ঠিক তো ! চলুন যেতে যেতে কথা বলি বলে মালা আর অলোক পাশাপাশি যেতে যেতে অনেক গল্প হলো !
সেই থেকে তাদের এক সুন্দর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে এবং শেষে তারা বিয়ে করে ঘর পেতেছে !
প্রথম পাঁচ বছর তারা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে গেছে ও চুটিয়ে আনন্দ করেছে ,একে অপরকে চিনেছে খুব ভালো করে তার পর অলোক বললো একটি বেবি দরকার এইবার ,পরের বছরের মধ্যেই তাদের একটা ছেলে হলো ! অলোক খুব ঘনঘন সিগারেট খেতো আর মাঝে মাঝেই নিজেকে খুব ভাবতো তাই দেখে একদিন মালা বললো কি ব্যাপার তুমি এত ভাবো কেনো ,অলোক খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললো সব কথা তোমাকে বলতে বলে আমি মনে করি না ! মালা তার কাছে এসে বললো আমি তোমার বউ তোমার সব মনের কথা আমাকে বলবে না তো আর কাকে বলবে ? অলোক দেখো ন্যাকামি মেরো না ,কাল আমি কলিকাতা যাবো , মালা বললো কেনো কোনো কাজ আছে ? কিছু না বলে অলোক বিছানায় শুতে চলে গেলো ,এইসব দেখে মালা আর ঘুম এলো না রাতে ! কলিকাতায় দিন পনেরো থেকে এলো ,এসে বললো আমার জন্য তোমাকে রান্না করতে হবে না আমি আমার রান্না নিজে করে নেবো ,তখন মালাও একটু অভিমান হয়ে বললো তুমি যদি একাই রান্না করো তবে একাই থাকো আমাকে আর ভালো লাগছে না বুঝি তোমার ! তবে বিয়ে কেনো করেছো ? এই কথাটা শুনে আলোক বললো তুমি খুব বাড়াবাড়ি করছো যেমনটি আছো তেমনি থাকো ওকে ,আমাকে বিরক্ত করো না ! এই কয়দিন আমাকে একা থাকতে দাও প্লিজ ! রাতের বেলায় অলোক মালার পাশে না শুয়ে নিজের অন্য বিছানায় শুতে গেলো ,এই দেখে মালার খুব অভিমান হলো অলোক কেন এমন করছে কিছু বোঝা যাচ্ছে না !
এইভাবে কিছু দিন যাবার পর অলোক একদিন বললো আমার কাজ আছে আমি বাইরে যাচছি বলে সেই যে গেলো আজ পাঁচ বছর হলো সেই আর আসেনি ,তখন থেকে মালা তার ছেলেকে নিয়ে একাই আছে ! মালা অনেক বার ফোন করেছে অলোক কে ,কিন্তু যতবার ফোন করেছে ঠিক ততবার অলোক তার ফোন কেটে দিয়েছে ,এই ভাবে তার সাথে আর কোন যোগাযোগ রাখেনি ! এই সব কিছু খবর মালার তার মা ও বন্ধু দের বলে ,তখন বন্ধুদের মধ্যেই অনেকেই বলে তুই আর একটা বিয়ে করে দেখা অলোক কে তুই ও পারিস ,কিন্তু মালা বলে না জীবনে অনেক পেলাম আর নতুন করে বসন্তের ফুল ফোঁটাতে চাই না ,বাকি জীভনটা না হয় অলোকের ভালোবাসার স্মৃতি বহন করে বেঁচে থাকতে চাই !
সেই তার ছেলে আকাশ কে বাকি জীবন টা কাটাতে চায় ! অলোক যেমন তাকে ছেড়ে একা থাকতে শিখেছে সেই রকম মালাও তার ছেলেকে নিয়ে একা থাকতে পারবে ,হয়তো সেই দিন গুলো ছিল খুবই সুখের কিন্তু আজ সময় খারাপ তা বলে নতুন করে সংসার নয় ! মালা শুধু একটা কথা ভাবছে অলোক এইরকম নয় কিন্তু কেনো এমন কাজ করলো ,তার কি অপরাধ হয়তো তার জন্য কি অলোক চলে গেলো এই ভেবে মালার দুই চোখ দিয়ে জল আসে !
এইভাবে কিছু দিন পার হলো ,মনের মধ্যেই সব চিন্তা ছেড়ে ফেলে ঠিক করলো সেই ডিভোর্স পত্রে সাইন করবে ,সেই অপেক্ষা করবে একদিন না একদিন অলোক আসবে ফিরে !
একদিন মালার মা মালা কে ফোন করে জানালো টিভি তে আজ নাকি অলোক কে দেখাবে ,তাকে নিয়ে একটা ইন্টারভিউ প্রোগ্রাম হবে স্টার জলসা তে ঠিক রাত আটটা সময় ! মনের মধ্যেই একটু আনন্দ হলো মালা কতদিন পর সেই দেখবে অলোক কে ! ঠিক রাত আটটা সময় রিমোট কন্ট্রোল নিয়ে টিভিতে দেখতে লাগলো ! একজন লোক বসে আছে তার অপর দিকে অলোক আছে বসে ,মুখে একগাদা দাড়িতে ভর্তি চেনার উপায় নেই ! মালা মনে মনে বললো কত রোগা হয়েছে এই সব মালার মন টা ভারি হয়ে গেলো ! সঞ্চালক অলোক কে জিজ্ঞেস করলেন ,আচছা অলোক বাবু আপনি কোন উদেশ্যের এত বড়ো একটা কাজ করলেন ? জবাবে অলোক বললো দেখুন আমার কোনো উদেশ্য নেই ! আমি খুব ঘনঘন সিগারেট খেতাম তাতে আমার গলাতে খুব ব্যাথা অনুভব করতো ,তখন আমি লোকাল ডাক্তার সাহেব কে দেখালাম ! ডাক্তার সাহেব দেখে বললো আপনার বোধহয় ক্যান্সার হয়েছে ,সেই কথা শোনার পর আমি কলিকাতা তে আসি এইখানে এসে ডাক্তার দেখিয়ে জানলাম সব কিছু ! যখন আমি আসি এইখানে তখন আমার চোখে পড়ে আমার মতোন অনেক রুগি আছে তারা সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছে না ,,আবার কেউ ঠিক মতোন শোয়ার জায়গা পাচ্ছে না ! তখন আমি মনে করি আমি যদি সুস্থ হয় তবে আমার যা টাকা আছে সেই টাকা দিয়ে তাদের জন্য একটি ক্যান্সারে আক্রান্ত রুগিদের জন্য হাসপাতাল খুলবো ! আপনাদের সহযোগিতা আমি খুলতে পেরেছি ! তখন সঞ্চালক বললেন এত কঠিন রোগের বিরুদ্ধে আপনি লড়াই করে জিতেগেলন ! অলোক বললো আমি লড়াই করে আজ সুস্থ হয়েছি তার জন্য আমি আমার স্ত্রী মালাকে ধন্যবাদ দেব ! আমি তার জন্য পেরেছি ,সেই না থাকলে আমি পারতাম না ! আমি চাই তাম না আমার এই রোগের সম্বন্ধেও মালা জানুক, আমি জানি সেই জানলে খুব কষ্ট পাবে ! তাই তো তাকে কিছু না জানিয়ে আমি পাঁচ বছর তাকে ছেড়ে আছি এই জন্য আমি মালার কাছে ক্ষমা প্রার্থী ! এই কথা শুনে মালার দুই চোখ জল বেয়ে এল ! মনে মনে বললো তুমি খুব স্বার্থপর তোমার এত বড়ো রোগের সময় আমাকে একবার ও ডাকলে না ,তুমি একা হাতে সব করলে সত্যি অলোক আমি খুব অপরাধি ,তোমার যোগ্য আমি নয় ! বলে রাগে টিভিটা অফ করে দিল মনে একরাশ অভিমান নিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো !
রাত যখন বারোটা বাজে ,ছেলেকে পাশে নিয়ে শুয়ে আছে মালা হঠাৎ তার মোবাইল টা বেজে উঠলো ,অচেনা নম্বর থেকে কে আবার ফোন করছে ? এই ভেবে মালা ফোন টা ধরলো ! ঐ পাশ থেকে অলোক বলছে দেখো তোমাকে আমি পাঁচ বছর ধরে অনেক কষ্ট দিয়েছি ,তোমাকে ডিভোর্স দিতে চেয়েছি বলে তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচছি ! আমি চাইতাম না যে আমার এই রোগ তোমাদের মধ্যেই ছড়াক এই জন্য তুমি যদি চাও আমি এখুনি তোমার কাছে যেতে চাই ! মালা এই কথা শুনে হাউহাউ করে কেঁদে বললো তুমি তোমার প্রয়োজনে আমাকে রাখলে না তুমি খুব নিষ্ঠুর ,পাঁচ বছরের অতীত কে ভুলে তুমি এখুনি এসো ! বাকি কথাটা ভেসে গেল তার কান্নায় ,সেই কান্না গলাতে বললো এত বড়ো খুশি খবর টা তোমার ছেলেকে দাও ! বলে ছেলেকে তুলে তার কানে মোবাইল টা ধরিয়ে দিল ! ছেলে আকাশ থতমত খেয়ে ফোন ধরে বললো বাপি তুমি এসো আমাদের কাজে ! মা রোজ তোমার জন্যই কান্না কাটি করে আর আমি ও করি ! অলোক বললো আমি এখুনি আসছি বেটা ! এত বড়ো খুশি মাঝে মালার সব দুঃখ ভুলে বললো পাঁচ বছরের যে কষ্ট তার থেকে আজকের রাত সব আনন্দে ভুলে গেলো আগামী দিনের কথা ! ডিভোর্স দেবে কিন্তু তা অলোক কে নয় ,নিজের কষ্ট কে সেই ডিভোর্স দিয়ে আনন্দে বাকি জীবনটা অলোকের সাথে কাটাবে ! মালা সারারাত জেগে থাকলো ! তার যে আজ খুশির দিন,সময় একদিন খারাপ ছিল সেই সময়ের যত কষ্ট তা আজ সেই কষ্ট টা ছাইচাপা পড়ে সুখের সাগরের ভাসতে লাগলো মালা ! এই মন যে তোমাকে চাই ,শুধু তোমাকে !
Tags:
Kahini/কাহিনী