এক ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ
ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
ডঃ অরুণ চক্রবর্তী
(রাজনৈতিক কাহিনী কবিতা)
সময় ৬ জুলাই, সাল ১৯০১,
স্বামী বিবেকাননদ, ধ্যান ভেঙে, উঠে,
শান্ত কন্ঠে নিমিলিত চক্ষে, নিজেকে বললেন, যাক্, ভুতো এসেছে, বাংলা বাঁচলো! তাঁর ধ্যান চক্ষে দেখা, মা কালীর আশীর্বাদে, এই শক্তিপীঠ বাংলা পেলো, ক্ষণজন্মা এক শিশুকে। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়র ও শ্রীমতী যোগমায়া মুখোপাধ্যায়ের সন্তান জন্ম নিলেন শামলাবরণ, সমর্থ শিশু, উজ্জ্বল চোখ দুটি, ক্ষণে ক্ষণে হাসি,
সে যুগের কলকাতার এলিট সমাজে হাইকোর্টের নামজাদা, আইনজীবী ও প্রখ্যাত গণিতজ্ঞ আর কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ের স্বদেশী উপাচার্য, তাঁর পরিবারে নতুন সদস্য, স্বপ্নে দেখা, মা কালীর, নামানুসারে, নাম রাখলেন শ্যামাপ্রসাদ? কিন্তু! কি আশ্চর্য্য! স্বামী বিবেকানদের মুখ থেকে বেরিয়ে যাওয়া শব্দ! ভুতো, কি করে মুখোপাধ্যায় বাড়ীতে ছড়িয়ে গেলো!? ছোট্ট শিশুর ডাক নাম রাখা হলো, ভুতো! আর একটা নাম, মা আদর করে রেখেছিলেন, বেণী। শ্যামাপ্রসাদ, মিত্র ইনস্টিটিউটশন থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন, পরে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট, বি এ ইংলিশ (অনার্স ) প্রথম বিভাগে, এম এ, পরে বাংলায় এম এ, সব কটিতেই প্রথম বিভাগে পাশ করেন। এল এল বি পরীক্ষায়েও ফার্স্ট ডিভিশন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা শেষ করে ইংল্যান্ডে যান লিঙ্কন-ইন-এ ব্যারিস্টারী পড়তে, ফেরেন বার-এট-ল হয়ে। যার কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি হিসেবে সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে অল্প সময়েই! মাত্র ৩৩ বছর বয়সে এই আশ্চর্য্য যুবক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ অলংকৃত করেন! তথা সমগ্র বিশ্বে বিশ্ব রেকর্ড করেন, এত অল্প বয়সে কেউ আজ পর্যন্ত উপাচার্য হতে পারেনি। তাঁর পিতার মতো তিনিও গণিতে অসাধারণ বুৎপওির জন্য ফেলো অফ দি রয়েল সোসাইটির সদস্য নির্বাচিত হন। এই যুবক উপাচার্য, বাংলা ভাষায় বিশ্ব বিদ্যালয় তথা কলেজ গুলোতে বাংলায় পঠন পাঠনে আরো সাবলীলতা আনেন ও বাংলা কে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেন। রবীন্দ্রনাথ, নিজে রাজী হন শ্যামাপ্রসাদের ডাকে, সর্বপ্রথম বাংলায় কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ে দীক্ষান্ত ভাষণ দেন! এক কথায় অভুতপূর্ব! এই অদ্ভুত ক্ষণজন্মার স্বল্প আয়ুর ভেতরে তিনি, আরো নিবিড় দেশসেবার জন্য, সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদান করেন, প্রথমে কংগ্রেস দলের সদস্য হিসেবে বিধানসভায় নির্বাচিত হন! পরে একবছরের ভেতর কংগ্রেস সদস্যরা সকলে পদত্যাগ করলে, তিনি পরের বার নির্দল সদস্য হিসেবে পুনরায় বিজয়ী হয়ে বিধানসভায় যান। কৃষক প্রজা পার্টির প্রগতিশীল সরকারের অর্থমন্ত্রী হয়ে বাংলার মেহনতী মানুষের স্বার্থ দেখতে থাকেন কিন্ত মন্ত্রিসভার কিছু সিদ্ধান্তের সঙ্গে তিনি সহমত না হতে পারার জন্য রাজ্য মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৪৬ এর হিন্দু বিরোধী দাঙ্গায় মানুষের পাশে দাঁড়ান ও মুসলিমদের পুরো বাংলা ও আসামের দখল নিতে বাধা দেন, আর বাংলা, আসাম ও পাঞ্জাব প্রদেশের অর্ধেক করে বাঁচিয়ে নিয়ে ভারতবর্ষে সংযুক্ত করেন। এই দূরদৃষ্টির জাতীয় নেতা ১৯৪৭ সালে মহাত্মা গান্ধীর ও পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর অনুরোধে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় ভারতের প্রথম শিল্প, ভারী শিল্প ও গণ বন্টন মন্ত্রী হিসেবে কার্য্য ভার সামলান, ওনার ও পন্ডিত নেহেরুর যুগম পরিকল্পনায় তৈরী হয়, ভারতের সুপার জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও বাঁধ, ভারতী নাঙ্গল, হিন্দুস্তান এ্যারেনটিক্স লিমিটেড, সিনধরী সার কারখানা, চিত্তরঞ্জন ডিজেল লোকোমোটিভ কারখানা, হিন্দুস্তান শিপ ইয়ার্ড, ভারত হেভী ইলেকট্রিকযালস এর মতোন, নতুন ভারতের বিশাল বিশাল কারখানা! যা আজো ভারতের ইন্ডাসট্রিয়াল মাইল ফলক! কিন্তু, আবার ন্যায় ও নীতির যুদ্ধ শুরু হলো, নেহরুর সঙ্গে ১৯৫২ সালে পদত্যাগ আর নতুন দল, জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা। লোকসভার নির্বাচনে ৩ জন নির্বাচিত! অন্যতম, শ্যামাপ্রসদ। লোকসভার ভেতরে একটি সম মনোভাবাপন্ন সাংসদ দের নিয়ে ৪৩ জন সাংসদ রাজ্য সভা ও লোকসভা মিলিয়ে, একটি ব্লক তৈরী হলো যারা ইস্যুভিত্তিক একটি দলের মতো কাজ করতে লাগলো, স্পিকারের কাছে একটি দল তৈরীর আবেদন নাকচ হয়ে যাবার পরে।
কাশ্মীর প্রসঙ্গ ও অন্যান্য বিভিন্ন বিতর্কের পটভূমিতে ডঃ শ্যামাপ্রসাদের ভাষণ ও তীক্ষ্ণ তর্ক শোনার জন্য প্রতিটি সাংসদ বিশেষ করে উপস্থিত
থাকতেন, প্রেস গ্যালারি ভরে যেতো, একটিই কারণ শ্যামাপ্রসাদ বক্তব্য রাখবেন! এই মণীষীর ভাষণ বিদেশী মিডিয়াও রেকর্ড করতো।
সারা ভারতে, স্বধীনতার পরে সমগ্র দেশে একই প্রতিবাদে আকাশ বাতাস মুখরিত হতে লাগলো, এক দেশ মে, দো নিশান, দো বিধান, দো প্রধান, নেহী চলেগি, নেহি চলেগি! কাশ্মির ভারতের এক অখন্ড অঙ্গ আর তাই, সেখানে দুটো সমান্তরাল ব্যবস্থা থাকতে পারে না! পরিস্থিতি এমন হলো, জনসঙ্ঘের ছায়ায় ঢেকে যেতে লাগলো কংগ্রেস, শ্যামাপ্রসাদ জম্মু তে ১৯৫২ সালে সভা করে বললেন, ভারত থেকে কাশ্মীরে ঢুকতে কেন পারমিট লাগবে? কেন সেখানে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মানা হবে না!?
ভারত প্রজাতন্ত্র এটা মেনে নিতে পারে না! হয় এসব বিলুপ্ত করব, না হয় প্রাণত্যাগ করবো! দেশ ও জাতি কে অক্লান্ত সেবা করে ভালোবেসে তিনি তাঁর প্রতিজ্ঞা রাখলেন, ১৯৫৩র এপ্রিল; তাঁকে ও তাঁর রাজনৈতিক সচিব অটলবিহারী বাজপেয়ী কে কাশ্মীরে রাভি ব্রীজের ওপরে পুলিশ বিনা পারমিটে ঢোকার অজুহাতে গ্রেফতার করলো আর উধমপুর হয়ে শ্রীনগর জেলে নিয়ে যাওয়া হলো, ওখান থেকে বেশ দূরে একটি আলাদা জংলা জায়গায় একটি স্যাঁতস্যাঁতে বাড়িতে বাখা হলো, অটল বিহারীকে ছেড়ে দেওয়া হলো, একটি মাত্র কম্বল ও সাধারণ বিছানায়, মেঝেতে শুইয়ে রাখা হয়, তিন দিনের মাথায় ওঁর সর্দি জ্বর হয়। ওনার ওপরে ভুল চিকিৎসা চালানো হলো, ওনার হাই-এ্যালার্জী থাকায়, “মাইসিন” গ্রুপ এর কোন ওষুধ বা ইনজেকশন দেওয়া পুরোপুরী নিষেধ থাকা অবস্থায়, জেনে বুঝে, ড: বিধান রায় ও ড: নীলরতন সরকারের বিশেষ প্রেসক্রিপশন কে তোয়াক্কা না করে, স্ট্রেপ্টোমাইসিন ইনজেকশন দেওয়া হলো যা, এক কথায় বিষ, ড: মুখার্জী, নিজেও বারণ করেন, কিন্তু শেখ আবদুল্লার চক্রান্তে ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতির সুযোগে, দুই অবস্থার সুযোগে, ঐ নিষিদ্ধ ইনজেকশন দেওয়া হলো। আর কয়েক ঘন্টার মধ্যে স্বামী বিবেকাননদের ভুতো, চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়লেন, আর ভারত অসময়ে হারালো তার প্রকৃত ভারত রতন কে। বড় অসময়ে। এই বিপুল পন্ডিত, মহা কর্মযোগী, ৪২ ও ৪৬ এর মহামারী, জাতি/ধর্ম দাঙ্গায় লক্ষ্য মানুষের এাতা, পশ্চিমবঙ্গের জনক, পাঞ্জাবের অভিভাবক, আসামের ত্যাগী দরদী পুএ, চির নিদ্রিত হলেন।
পশ্চিম বঙ্গ, পাঞ্জাব আর আসামে হাজার হাজার মানুষ পাগলের মতোন হা হুতাশ করতে থাকেন, ঘরে ঘরে অরন্ধন, দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, জাতীয়স্তরের নেতৃবৃন্দ, কি কংগ্রেস, কি বিরোধী, তাঁদের কান্না চেপে রাখতে পারেনি! পন্ডিত নেহরু কে, তাঁর কনিষ্ঠা ভগিনী বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিত, অবিলম্বে বিদেশ সফর বাতিল করে দেশে ফিরতে বলেন, নেহরু চট জলদি দেশে ফেরেন, ফেরা মাত্র ড: শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা পর্যালোচনা শুরু হয়, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে, গোপনে তিন মূর্তি প্রধানমন্ত্রী নিবাসে, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে, এই রাজনৈতিক হত্যার যোগ্য বিচারের দাবী ওঠে! কংগ্রেস নেতা কে কামরাজ, সরাসরি শেখ আবদুল্লার তৎকাল গ্রেফতার চান! অন্য নেতাদের মধ্যে কৃপালনী, ওয়াই বি চবন, ড: বিধান চন্দ্র রায়, যাঁর প্রভার পন্ডিত নেহেরুর ওপরে অত্যন্ত বেশী ছিলো, শ্রী অতুল্য ঘোষ, হুমকি দেন, কংগ্রেস টুকরো করে দেবেন, যদি না আবদুল্লা কে জেলে ঢোকান হয়, শ্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেন, কেঁদে ফেলেন, মহারাষ্ট্র প্রদেশ কংগ্রেস তীব্র প্রতিবাদ করে পন্ডিত নেহরু কে, শেখ আবদুল্লাকে অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবী জানায়, কাশ্মীরের রাজপরিবারের সদস্যরাও একইভাবে বিচার চান প্রধানমন্ত্রীর কাছে! কাশ্মীর থেকে কণ্যাকুমারী রাগে কাঁপতে থাকে, প্রতিটি রাজ্য ক্রোধে ফুঁসতে থাকে! দেশনায়কের পার্থিব শরীরের লোকসাগরে লক্ষ্য লোকের কালো মাথার ঢেউয়ে ঢেউয়ে বার বার ঢাকা পড়তে হয়! কমিউনিস্ট নেতা, আর এক রাজনৈতিক জ্যোতিষ্ক প্রফেসর হীরেন মুখার্জী শোকাপ্লুত হয়ে বলেন, এক মহান জ্ঞানী ও দেশমাতার প্রকৃত সন্তান বলিদান দিলেন!
পন্ডিত নেহরু; শ্যামাপ্রসাদের মাতা, যোগমায়া দেবী কে লেখেন, মা, দেশের এক অপুরনীয় ক্ষতি, আমার কনিষ্ঠ ভাই ও সহকর্মী শ্যামাপ্রসাদের চলে যাওয়া আমাকে শোকস্তব্ধ করেছে, বার বার বলে গিয়েছিলাম, ওনার যেন যত্ন নেওয়া হয়! কোনরুপ ভেদভাব যেন দেখানো না হয়! আমি পরিবারের সঙ্গে আছি।
দলের সিদ্ধান্ত ও সরকারের মনোভাব কঠোর হলো দিনেদিনে, পন্ডিত নেহরু এটাই চাইছিলেন, শ্রীনগর থেকে শেখ আবদুল্লাকে গ্রেফতার করে দিল্লির তিহার কারাগারে রাখা হয়, তার কৃতকর্মের জন্য...... অন্যান্য রাজনৈতিক কারণও ছিলো।
যতদিন নেহরু বেঁচেছিলেন, ততদিন শেখ আবদুল্লা মুক্তি পায়নি। এমন কি ইন্দিরার ওপরেও ঐ একই নির্দেশ ছিলো! মাত্র ১৯৬৭ তে দীর্ঘ ২১ বছর জেলে থাকার পরে মুক্তি দেওয়া হয়! কিছুদিন মুখ্যমন্ত্রী থাকার পর আবদুল্লার মৃত্যু হয়।
শ্যামাপ্রসাদ এক অনন্য নজির রেখে চলে গেলেন মা জগদম্বার চরণে!! এই মনীষী সমগ্র ভারতকে নতুন দিশা দিতে পারতেন, দিতে পারতেন এক শক্তিশালী ও সুখী ভারত। শ্যামাপ্রসাদ, হতে দিওনা মোদের কাহারো ক্রীতদাস, করি সবাই এই বিশ্বাস।
শ্যামাপ্রসাদ, দাও স্বর্গ হতে আশীর্বাদ,
যেন রাখিতে পারি দেশের, দশের, সম্মান অপার, দাও সে আশ্বাস, শ্যামাপ্রসাদ, জন্ম লহ বারেবার, ফিরাতে জাতির হারানো, অপসৃয়মান এক জাতি, এক প্রাণ,
পাই যেন সবে, আত্মবিশ্বাস।।
(REGISTERED UNDER COPYRIGHT ACT)