হারিয়ে যাওয়া খেলাগুলো
~ সূরজ নন্দী
আমরা যারা আগের শতকের নব্বইয়ের দশকে জন্মেছি, তারা যথারীতি পৃথিবীটাকে একটু অন্য চোখেই দেখতাম । এখনকার মতো আধুনিক প্রযুক্তি তো তখন আমাদের হাতে আসেনি, তাই স্মার্টফোন হোক বা ল্যাপটপের গেম আমাদের কাছে অজানা ছিলো । স্কুলে কম্পিউটার ক্লাস হতো বটে, কিন্তু ঘরে ঘরে কম্পিউটারের যে মহিমা আজ সর্বত্র বিস্তৃত আমাদের পৃথিবী সেই স্বাদ জানতো না । ছেলেবেলায় আমি তো ল্যান্ড লাইনে কথা বলতেও প্রথম প্রথম ঘাবড়ে যেতাম । সারা পাড়ার মধ্যে একটি কি দুটি ল্যান্ডলাইন ছিল, টিভিও ছিল দুটো । আর চ্যানেলের মধ্যে ছিল শুধু ডিডি বাংলা আর ন্যাশনাল টিভি । এটাই ছিল আমাদের প্রাত্যহিক এন্টারটেনমেন্টের প্রযুক্তির জীবন ।
আমাদের ঘরের জীবনটা ততটা আকর্ষণীয় ছিল না । বাইরের জন্যই সব সময় মন থাকতো উদ্বিগ্ন । আউট গেমের মধ্যে ছিল যেমন খেলেছি ক্রিকেট-ফুটবল, গুলিডান্ডা, লুকোচুরি, ধরাধরি, মাংসচুরি ইত্যাদি সাথে সাথে মেয়েদের সাথে লাফান দড়ি, পাতাপুতি, পুতুলখেলা, খেলনাবাটি, কিত্কিত্ এসব খেলাও খেলেছি । আবার ইনডোর গেমের মধ্যে ক্যারাম, রাম-লক্ষণ, চোর-পুলিশ, ইকির-মিকির, আগডুম-বাগডুম, গানের লড়াই, নামের লড়াই এরকম কত খেলা যে ছিল তার ইয়াত্তা নেই ।
আজকের শৈশব এসবের স্বাদ জানে না । তাতে অবশ্য দুঃখ করার কিছুই নেই , পরিবর্তন সময়ের অনিবার্য নিয়ম । আমাদের বাবা কাকাদের সময় কার খেলাই বা আমরা কটা খেলেছি ? তবে এখনকার মোবাইল বা কম্পিউটার গেমিং শৈশব মুজে আছে । খেলার মাঠে দৌড়ে আমরা যে আনন্দ পেতাম সেটার স্বাদ এ জেনারেশন জানে না ।
'ক্রিকেট' বা 'ফুটবল' এখনো ছেলেমেয়েরা খেলে, তবে বাইরে বেরিয়ে কতজন খেলে বা ভবিষ্যতে কতজন খেলবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে । আমাদের কাঠের ব্যাট বল উইকেট কেনার টাকা ছিল না । অতএব কখনো নারকেল পাতার সাঁড়া দিয়ে ব্যাট অথবা বাঁশের বাখারি দিয়ে বা ইটের উপর ইট সাজিয়ে উইকেট বানিয়েই হত খেলা । প্লাস্টিকের বল হারিয়ে গেলে অনেক সময় বল হিসেবে ব্যবহার হতো মাঝারি সাইজের বাতাবি লেবু । খেলোয়াড়দের গাছে পাওয়া না গেলে, অন্য লোকের কাছ থেকে চুরি করে পেড়ে আনতাম ।নিয়মও ছিল বেশ - ছক্কা মারলে বা বল হারালেই আউট ।
'ফুটবল' খেলার আসল মজা ছিল বৃষ্টিতে বা বৃষ্টি শেষে কাদায় । সকলে জামা অথবা গেঞ্জি খুলে সেই কাদার মধ্যে দৌড়ঝাঁপ করে একে অন্যের পা থেকে বল পেয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতাম । ফলে কাদায় মাখামাখি হয়ে হড়কে পড়তাম বারবার । সেই পড়াতেও মজা ছিলো বেশ । অনেক সময় অন্যকে ফেলার চেষ্টা করতে গিয়ে নিজেই পড়ে যেতাম । পা থেকে মাথা পর্যন্ত কাদায় মাখামাখি হয়ে শেষ পর্যন্ত পুকুরে স্নান করে বাড়ি ফেরা ।
'গুলিডান্ডা' খেলাটা ছিল একটু বিপজ্জনক । গুলির সুচালো কোনটা চোখে লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকতো, কিন্তু কে কতদূর পাঠাতে পারে বা লক্ষ্যভেদ করতে পারে কিনা সেটা একটা দেখার বিষয় ছিল বৈকি ।
এর পাশাপাশি গুলি বা মার্বেল খেলা ছিল খুব বিখ্যাত । প্রচণ্ড গরমে ক্রিকেট অথবা ফুটবল খেলা যেত না তখন গুলিই ছিল ভরসা । টাকায় দশটা রঙিন মার্বেল পাওয়া যেত । সেটা কেনার জন্য টিফিনের পয়সা বাঁচাতাম । নানান রঙের দাগ মিলিয়ে গুলি কিনে জমানোও ছিল একটা নেশা ।
শীতকালে আরেকটা খুব বিখ্যাত খেলা ছিল ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা । এখনকার মতো মাঞ্জা দেওয়া সুতো তখন কেনার টাকা ছিল না । ফলে ভাতের ফ্যান, সাবুদানা, কাচের গুঁড়ো এসব দিয়েই সুতোয় মাঞ্জা দিতাম । হাত কেটে যেত - কিন্তু সে পরোয়া আর করে কে ? পাশের গ্রাম থেকে ঘুড়ি বাড়তে বাড়তে আসতো আমাদের মাঠে - আমরা প্রস্তুত থাকতাম কাটার জন্য । তারপর কাটা ঘুড়ি লুট করা নিয়ে কতদূর থেকে কতদূর পর্যন্ত যে দৌড়েছি তার কোনো সীমা নেই । তবে ঘুড়ি কপালে জুটতো কম । বেশিরভাগই গাছে অথবা পুকুরে গিয়ে পড়তো আর যদিও একটা ঘুড়ি অতিকষ্টে হাতে পাওয়া যেত তার সুতোটা পড়তো অন্য জনের হাতে । সুতরাং টানাটানিতে হয় ছিঁড়ে যেত আর না হয় ছিঁড়ে দেওয়া হতো ।
গুলতি নিয়ে ফল পাড়া ছিল গ্রীষ্মের দুপুরের একটা নেশা । বাবা মা ঘুমিয়ে পড়লে চুপিচুপি পাশ থেকে উঠে এসে গুলতি নিয়ে যেতাম আম, জাম, জামরুল পাড়তে । কখনো কখনো পাখিও ধরেছি তাই দিয়ে । গুলটির জন্য মাটির গোল গোল গুলি তৈরি করতাম । এটেল মাটির রোদে পোড়ানো গুলি, আর না হলে বেলে মাটির আগুনে পোড়ানো গুলি ।
ইংরেজি দয়ায় 'লুকোচুরি' খেলাটাকে এখনকার ছেলেমেয়েরা 'হাইড অ্যাণ্ড সিক' বলে জানে । বাংলার সর্বনাশ হয়ে গেল। সে যাই হোক, এটি ছিল ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে একটি খেলা । একজন হত পুলিশ আর বাকিরা হতো চোর । চোর লুকাবে আর পুলিশ খুঁজবে । তবে বুঝতে যাতে সমস্যা না হয় তার জন্য আমরা একটা বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করতাম । যাকে প্রথম দেখতে পাওয়া যাবে তাকে বলতে হবে এক পেঁয়াজ, পরের জনকে দোপিঁয়াজ, তারপরের জন কে তিন পেঁয়াজ - এভাবেই চলতে থাকবে খেলা । যদি গুনতিতে ভুল হতো তবে "থুক্কুড়ি" দিতাম , অথবা সবাইকে খুঁজে বের করতে না পারলে বা লুকিয়ে থাকা কেউ "ধপ্পা" দিয়ে দিলে - ব্যাস আবার পুনরায় পুলিশকেই পুলিশ হতে হতো তাকে ।
'ধরাধরি' খেলা ছিল ভীষণ মজার । একজন থাকবে চোর আর একটি নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে বাকি কয়েকজন থাকবে প্রস্তুত । চোর তাড়া করে যাকে একবার ছুঁয়ে দেবে, সেই হবে পরবর্তী চোর । তবে নিয়ম ছিল একজনের পিছনে বেশিক্ষণ তাড়া করা যাবে না । একই রকম খেলা ছিল 'কানামাছি' এতে শুধু চোরের চোখ বাঁধা থাকতো আর বাকিরা তাকে ঘুরে ঘুরে বলতো "কানামাছি ভোঁ ভোঁ যাকে পাবি তাকে ছোঁ" । আবার 'চাবিতালা' খেলাও ছিলো এরকমই । এতে চোর সামনে এলে বসে পড়তে হতো । সে মাথায় ছুঁয়ে দিলে তালা পড়ে যেত । যতক্ষণ না অন্য স্বাধীন কেউ এসে মাথায় হাত দেয় ততক্ষন এক জায়গায় বসে থাকতে হতো । আর চোর দিতো পাহারা, যাতে বন্দি করা কাউকে অন্য কেউ স্বাধীন করতে না পারে ।
'মাংস চুরি' খেলায় মাংস ছিল ইটের কুচো । সেগুলো সাজানো থাকতো একটি বৃত্তে । একজন চোর হয়ে সেই বৃত্তে পাহারা দিত তার আগল থেকে মাংস চুরি আনতে হতো যদি সে কাউকে ছুঁয়ে ফেলত তবে সে পরবর্তী চোর হয়ে পাহারা দিত । আর সব মাংস চুরি হয়ে গেলে আগের জনই আবার চোর থাকত ।
খেলার প্রথম চোর কে হবে তা নিয়ে নানা রকমের ছড়া থাকতো আমাদের । এখনকার ছেলেমেয়েরা তো স্টোন পেপার সিজার খেলে । আমরা সবাই একসাথে গোল হয়ে দাঁড়াতাম তারপর একজন এক একটা শব্দে এক এক জনকে গুনে গুনে ছড়া কাটতো :
" আপন বাপন চৌকি চাপন
ওল ঢোল মামার খোল
ওই ছেলেটা খাঁটি চোর"
অথবা, "দশকুড়ি নাড়িভুঁড়ি
চিংড়ি মাছের চচ্চড়ি
কে কত আনা নেবে
বলে দাও না"
আবার "দশ কুড়ি তিরিশ চল্লিশ
পঞ্চাশ ষাট সত্তর আশি
নব্বই শ ।
শ'য়ে শ'য়ে মিলে গেল,
প্রজাপতি উড়ে গেল,
প্রজাপতির নাম কি
দুর্গা ঠাকুর মাঈকি"
যার কাছে গোনা শেষ হবে সে হবে চোর ।
এছাড়াও সুপারি গাছের শুকনো পাতা নিয়ে একটা মজার খেলা হতো। পিছনের খোলাটায় থাকতো একজন বসে আর সামনের পাতাগুলো ধরে অন্যজন টানতো । আবার সুপারি গাছের ছোটোফল ঢাকা রাখার খোলস দিয়ে নৌকা বানিয়ে তাতে গুটিকয়েক পিঁপড়ে ছেড়ে নৌকার মত করে জলে ভাসাতাম । সেটাও ছিল একটা মজার খেলা ।
তাছাড়া কলা গাছের গুড়ি দিয়ে সাঁতার কাটা অথবা উঁচু ডাল থেকে পুকুরে ঝাঁপ দেওয়ায় ছিলো খেলারই অংশ । আবার সাঁতার কাটার প্রতিযোগিতাও করেছি অনেক সময় ।
মেয়েদের খেলা ছিলো বেশ মজার । কখনো কখনো খেলার জন্য বন্ধু না পেলে মেয়েদের সাথেও সমান আনন্দে তাদের খেলা খেলেছি ।
মেয়েদের ছিল 'খেলনা বাটি' । বালি দিয়ে ভাত, বনপাতা দিয়ে তরকারি, ইট দিয়ে মাংস, গোল পাথর দিয়ে ডিম বানানো হতো । সিরাপের বোতলের মুখ লাগানো দস্তার ছিপি ঘুরিয়ে কেটে কেটে কচু পাতা দিয়ে বানানো হতো লুচি । তাছাড়া রাস্তার ধারের একধরণের ছোটো বিরুৎ জাতীয় গাছের প্রায় গোল পাতার নামই হয়ে গিয়েছিল লুচিপাতা । লঙ্কাশির গাছের সরু সরু দানা দিয়ে বানানো হতো পোস্ত । সাজানো গোছানো সংসার ।
লাফানদড়ি এখন যার নাম হয়েছে 'স্কিপিং' । না থেমে, না আটকে কতক্ষণ কে করতে পারে তাই নিয়ে ছিলো আমাদের প্রতিযোগীতা ।
'কিতকিত' ছিলো মেয়েদের মধ্যেখুব বিখ্যাত । ভাঙা হাঁড়ির কানাকে গোল করে তৈরি করা হতো ঘুটি । তাই দিয়ে নয় ঘরের 'এক্কা-দোক্কা' বা এগারো ঘরের 'ঘর কেনা'র খেলা বা 'প্রজাপতি' খেলা ছিলো ভীষণ মজার । তবে প্রতিটা খেলাই খেলতে হতো মাটিতে দাগ কেটে ঘর বানিয়ে, একটি পা তুলে অন্য পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে । আর সাথে সাথে খেলা শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত নিঃশ্বাস না ছেড়ে । কতকটা কাবাডির মতো । নিঃশ্বাস পড়ে গেলে বা লাগে পা পড়লেই আউট ।
আর একটা বিখ্যাত খেলা ছিল 'পাতাপুতি' খেলা । এ খেলাটায় প্রত্যেকের ছিলো নিজস্ব ঘর । চোর থাকত বাইরে । নজরে পড়ে এমন একটি পাতার নাম বলবে চোর । বাকিরা একপায়ে সেটি সংগ্রহ করে আনবে । দু পা ফেলা অবস্থায় চোর ছুঁয়ে দিলেই চোর হতে হবে । পাতা ঘরে এনে চোরের নজর এড়িয়ে পাতার অংশবিশেষ লুকাতে হতো মাটির নীচে । চোরকে প্রত্যেক ঘরে পিছু মাত্র তিনটি আঁচড়ে সেটাকে খুঁজে বের করতে হতো ।
ছিলো 'আলতাবাটি', 'বৌ-বসন্ত' খেলা । আলতাবাটিতে চোরকে ছড়া কেটে জিজ্ঞাসা করতে হতো : "আলতাবাটি পানেরবাটি পা ধুয়ে দাও, জল নেবে না আড়া (ডাঙা) নেবে তা বলে দাও ।" ডাঙা অর্থাৎ উঁচু জায়গা আর জল অর্থাৎ নীচের মাটি । চোর যে বিকল্পটি বেছে নেবে সেই জায়গায় উঠে তাকে ভেঙচি দেখাতাম আমরা । ছুঁয়ে দিলেই চোর । বৌ-বসন্তে শত্রুর কবল থেকে তাদের ছোঁয়া বাঁচিয়ে বৌকে নিজেদের ঘরে আনাই ছিলো উদ্দেশ্য ।
ইনডোর গেমের মধ্যে ক্যারাম, লুডো তো এখনো ছেলেমেয়েরা খেলে, কেউ কেউ তো মোবাইলেও এসব খেলে। এগুলো ছাড়াও ছিলো কাগজের মধ্যে চোর-ডাকাত-পুলিশ-বাবু লিখে ও তাদের মান বসিয়ে নম্বর জোগাড় করার খেলা । চারজনের খেলা এটি । কাগজগুলো ছড়িয়ে দিয়ে একটি করে কাগজ চারজন কুড়িয়ে নেওয়া হতো তারপর পুলিশ পড়তো যার ভাগ্যে সে খুঁজতো চোর আর ডাকাতকে । আর সেই অনুযায়ী নম্বর লেখা হতো অন্য পাতায় । শেষে কত বেশি পেতে পারে - এই ছিলো প্রতিযোগীতা ।
রাম-লক্ষণ খেলাও কাগজের খেলা । রামায়নের একাধিক চরিত্রকে নিয়ে প্রতি চরিত্র পিছু চারটি করে কাগজ নাম লিখে মুড়ে রাখা হতো । প্রতি খেলোয়াড়কে তাস খেলার মতো করে কাগজ আদান-প্রদান করে রাম-সীতা-লক্ষণ-ভরত-শত্রুঘ্ন মেলাতে হতো । তার প্রথম হবে সে-ই হতো বিজেতা ।লোক বেশি থাকলে আরো চরিত্র রোগ করা হতো ।
'ইকির-মিকির' ছিলো আঙুল গোনার খেলা । এ খেলার ছড়া ছিলো :
ইকির-মিকির চামচিকি
চামে কাটে মজুমদার
ধেয়ে এলো দামোদর
দামোদরের হাঁড়ি-খুরি
গোয়ালে বসে চাল কুটি
চাল কুটতে হলো বেলা
ভাত খাবিতো জামাই শালা
ভাবতে পড়লো মাছি
কোদাল দিয়ে চাঁচি
কোদাল হলো ভোঁতা
খ্যাঁকশেয়ালের মাথা ।
মে আঙুলে খুন্তি শেষ হবে সে আঙুল মুড়ে রাখতে হবে । সেটি আর গোনা হবে না । প্রেম আঙুল থেকে গোনা শুরু । প্রথমে তার সব আঙুল মোড়া হবে সেই বিজয়ী ।
ছিলো 'আগডুম-বাগডুম' খেলা । গোল হয়ে বসে হাঁটু গুনে গুনে খেলা । এ খেলার ছড়াটি হলো :
"আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে
ঢাক মাদল ঝাঁঝর বাজে
বাজতে বাজতে চললো ডুলি
ডুলি গেলো তার কমলাফুলি
কমলাফুলির টিঁয়েটা
সূয্যিমামার বিয়েটা
আয় রঙ্গ হাটে যাই
গুয়া পান কিনে খাই
একটি পান ফোপরা
মায়ে-ঝিয়ে ঝগড়া
হলুদ বনে কলুদ ফুল
শিবের নামে টগর ফুল ।"
আর ছিল 'রুমাল চুরি' খেলা । সবাইকে গোল হয়ে মাথা নীচু করে বসতে হবে । একজন থাকবে চোর । তার হাতে থাকবে একটা রুমাল । পিছন দিয়ে গোল হয়ে ঘুরতে ঘুরতে সে কোনো একজনের পিছনে লুকিয়ে রেখে দেবে রুমাল । যারা মাথা নীচু করে বসে থাকবে তারা মঝেমধ্যে পিছনে হাত দিয়ে দেখবে রুমাল রেখে গেছে কি না । যদি রুমাল পেয়ে যায় তবে চোরের তিনবার পাক দিয়ে আসার আগেই রুমাল নিয়ে উঠে পড়ে চোরের জায়গাটি নিতে হবে । আর চোর এসে বসবে তার জায়গায় । আর যদি রুমাল খুঁজে না পাও তবে পেটে চোরের কিল খেতে হবে ।
এরকম আরো অনেক খেলায় রঙিন ছিল আমাদের শৈশব । আমরা তখন গ্যাজেটের দুনিয়ায় আবদ্ধ হইনি । দৌড়ঝাঁপ করে খেলার একটা আনন্দ, খেলায় জিতে গেলে অন্য বন্ধুকে জড়িয়ে ধরার একটা খুশির অনুভূতি ছিল অতুলনীয় । একে অন্যকে ছুঁয়ে খেলা একে অন্যের সাথে খেলার ছলে লড়াইয়ের আর প্রতিযোগিতার একটা আনন্দ ছিলো । তার কতটুকু একবিংশ শতাব্দীর ছেলেমেয়েদের শৈশবে আছে তা বুঝিনা । তবে হাত-পা ভেঙে যাওয়া বা নানা শারীরিক ক্ষতির সম্ভাবনা থেকে যে সমস্ত অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের মোবাইল ফোন দিয়ে ঘরের মধ্যে বন্দি রাখতে চান, তারা এক রকম ছেলেমেয়েদেরকে শারীরিকভাবে দুর্বল করেই তুলছেন । বাইরের ধুলোমাটি, জলকাদায় আপাত অসুস্থতা নিঃশ্চই ছেলেমেয়েদেরকে ঘিরে ধরে, কিন্তু এগুলো তাদের ভেতর থেকে শক্তিশালী করে তোলে । ফলে পরবর্তীকালে তারা অনেক বড় বড় অসুখ এর সাথে মোকাবিলা করার শক্তি পায় ।
যাইহোক এগুলোই ছিল আমাদের ছোটবেলার সঙ্গী, আনন্দের উপায় । এই খেলাগুলোর কিছু কিছু হয়তো এখনো বজায় আছে । কিন্তু আদৌ তা কতদিন থাকবে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ অবশ্যই থেকে যায় । এগুলো আমরা পুর্ব প্রজন্মের হাত ধরে শিখেছি এবং পরবর্তী প্রজন্মকে শিখিয়ে দিয়ে যাব । এবার সে গুলোকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব তাদের । যদি মন না চায়, হয়তো চলতি পথের ধারে তারা মুখ বন্ধ কোনো ব্যাগের ভিতর করে ফেলে রেখে যাবে । তাতে আপত্তি নেই । আমাদের সম্পদ তো তাদের হাতে তুলে দিয়ে গেলাম, এতেই আমাদের স্বস্তি ।